
নিজস্ব প্রতিবেদক :
মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ১২টা ১০ মিনিটে তার ফাঁসি কার্যকর হয়।
গত ৫ মে বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৪ বিচারপতির বেঞ্চ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন বা রিভিউ খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
কাশিমপুর কারাগারে থাকা নিজামীকে ওই দিনই মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার খবর জানানো হয়। পর দিন শুক্রবার নিজামীর পরিবারের সদস্যরা তাঁর সঙ্গে দেখা করেন।
এর পর রোববার রাতে মতিউর রহমান নিজামীকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়।
সোমবার দুপুরে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিচারপতিরা রায়ে স্বাক্ষর করেন। এরপর রায়টি প্রকাশ করা হয়। এর পর দ্রুতই নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতি শুরু হয়।
রায় প্রকাশের পর সোমবার বিকেলে রায়ের কপি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ট্রাইব্যুনাল থেকে রায়ের কপি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া রায়ের কপি আইন মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়েও পাঠানও হয়।
রাত ৮ টার দিকে রিভিউয়ের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি ট্রাইব্যুনাল থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে।
রায়ের কপি কারাগারে পৌঁছানোর পর কারা কর্তৃপক্ষ ফাঁসির আসামি নিজামীকে এই রায় পড়ে শুনিয়ে জানতে চান তিনি কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না।
সোমবার রাত থেকেই কারাগার এলাকার নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। অতিরিক্ত পুলিশ এবং র্যাব মোতায়েন করা হয়।
মঙ্গলবার বিকেলে প্রধান জল্লাদ রাজুকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেল তিনটার পরে রাজু কারাগারে প্রবেশ করে।
একই সময় ‘নিজামী এখনও রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করেননি। প্রাণ ভিক্ষার আবেদন না করলে যেকোনো সময় নিজামীর রায় কার্যকর হবে’ বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
এদিকে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কারাগার এলাকায় নিরাপত্তা আরও বাড়ানো হয়। কারা অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কারাগার পরিদর্শন করেন। সন্ধ্যার পর বিপুল পুলিশ এবং র্যাব মোতায়েন করা হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় আশেপাশের এলাকার যান চলাচল। কারাগারের ভেতরে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়।
সন্ধ্যায় ছয়টার দিকে নিজামীর সাথে দেখা করতে তার পরিবারকে খবর পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ। উত্তরা বাসা থেকে নিজামীর স্বজনরা সন্ধ্যায় ৭ টায় রওনা দেন। সন্ধ্যায় ৭ টা ৫০ মিনিটে পরিবারের ২২ জন সদস্য তিনটি জীপে করে কারা ফটকে পৌঁছান।
এদিকে মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষায় ঢাকার শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা অবস্থান নিয়েছেন। চলছে প্রতিবাদী গান ও স্লোগান।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে এক মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
২০১৩ সালের ২৮ মে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ এনে নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল।
২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীর বিরুদ্ধে আনা ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি (১, ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৮ ও ১৬) অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডসহ হত্যা-গণহত্যা ও ধর্ষণের প্রমাণিত ৮টি মানবতাবিরোধী অপরাধে নিজামীকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ৪টিতে ফাঁসি ও ৪টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয় তকে।
এর পর ওই বছর ২৩ নভেম্বর উচ্চ আদালতে আপীল করেন নিজামী।
পরে গত ৬ মার্চ ২০১৬আপিলের রায়ে ৩ টিতে ফাঁসি ও ২ টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ বহাল রাখে সুপ্রিমকোর্ট। সেই আদেশের পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করে নিজামী ।
৫ মে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৪ বিচারপতির বেঞ্চ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন বা রিভিউ খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
এর মাধ্যমে নিজামীর মামলার সব ধরনের আইনি প্রক্রিয়া শেষ হয়। এর পর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনের সুযোগ থাকলেও বাকীদের মত নিজামীয় রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা না চাওয়ায় মঙ্গলবার রাতে (১০ মে, ২০১৬) তার ফাঁসি কার্যকর হয়।
এর আগে ২০১৪ সালের গত ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সিনিয়র স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মজিবুর রহমান ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় মতিউর রহমান নিজামীসহ ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন।